অকল্পনীয় কষ্ট
মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন যে কত বেদনাদায়ক নিজে এর মধ্য দিয়ে না গেলে বোঝা যায় না। এটি যে কেবলই সাময়িক কষ্টের সাধারণ অনুভূতি তা নয়, বরং এই অনুভূতির রেশ এতটাই গভীর ক্ষত তৈরী করে যে, যেকোন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিতে পারে। যাকে আপনি মন দিয়ে ভালবাসেন সে-ই যদি মানসিক ও দৈহিক নির্যাতনের কারণ হয়, তবে মনে হবে যেন সমস্ত পৃথিবী ভেঙ্গে আপনার উপর এসে পড়েছে, মনে হবে যেন সব স্বপ্ন গহীন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। কোন নির্যাতনই যে সহ্য করা যায় না, তা আমি আমার ভগ্নপ্রায় বিবাহিত জীবনের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি। এই নির্যাতন যে কেবলই আমার শারীরিক ক্ষত তৈরী করেছিল তা নয়, বরং হৃদয় ভেঙ্গে ক্ষত বিক্ষত হয়েছিল, আর মনের পর্দায় গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল।
এই হারানোর ব্যথা আর নির্যাতনের কষ্ট ভুলে থাকতে আমি নীচের এই কবিতাটি লিখেছিলাম:
গল্পে গল্পে দু’জন কত সময়ই না কাটিয়ে দিয়েছি সেথা;
ছোট ছোট জিনিসে ঝগড়া করেছি,
তবু দু‘জন দু‘জনকে ভালবেসেছি;
রাত জেগে কথা বলেছি, গোপন কথা খুলে বলেছি;
অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখেছি, জেদ করেছি,
রাগ করেছি, তবু তোমার ফোনের অপেক্ষায় থেকেছি;
একই ছবি তোমার দেখতাম বারবার,
একই লেখা তোমার পড়তাম বারবার;
মনের অজান্তেই হাসতাম,
অন্ধভাবে বিশ্বাস করতাম;
তোমার আলিঙ্গন আর চুম্বনে দিশেহারা হয়ে যেতাম,
তোমার নিস্পাপ ইচ্ছাগুলি কান পেতে শুনতাম।
আর এখন বিয়ের পর খালি পড়ে থাকে আমার ইনবক্স,
ফোন করে কেউ বলে না আর তোমাকে ভালবাসি;
আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত আমি,
ব্যথা নির্যাতনে জর্জরিত আমি;
একাকিত্ব আর আবেগের চিৎকার ধ্বনি,
মধ্য রাতের হাহাকার আর গোপন কথার স্তব্ধতা একা একা গুনি;
স্বপ্ন শুন্য নির্জনে কাঁদে হতভাগে বিশ্বাসঘাতকতায়,
স্মৃতির পাতা থেকে মুছে দিয়ে সবই ভরে দিলে বেদনায়;
দুঃখ প্রকাশের মুখোশ পরিয়া,
রইলে নকল হাসি আর বিশ্বাসের ভাঙ্গা তরী সাজাইয়া;
কেন যে তোমার সাথে প্রেমে মাতিলাম ভেবে পাই না এখন আমি !
যতবার তার সাথে আমার ঝগড়া হতো, ততবারই আমি ভীষন মানসিক যন্ত্রনায় নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলতাম। এতে সে আরও রেগে যেত এবং মারধর করতো। কোন কোন ঝগড়ায় যদি কখনো সে আমার অনুভূতি বুঝতে পারতো, আমি তাকে বিশ্বাস করতাম, ভরসা পেতাম। বিশেষ করে তার হিন্দু পরিবারের হস্তক্ষেপ, তার মদ্যপানে আসক্তি ও তার নিষ্ঠূরতার কারণে, তার কাছে আমার কোন মূল্যই ছিল না। আসলে সে সবসময়ই আমাকে কৃতদাসীর মত মনে করতো।
মদের নেশা তাকে শেষ করে দিয়েছিল। সে যখন নেশাগ্রস্থ থাকতো তখন সে তার বিচার বুদ্ধি আর বিবেকের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতো, আর বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সেই সময়ই সে আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতো। কথাটা বাজে শোনালেও, যতটুকু তার ভালবাসা পাবার কথা না তার চেয়েও বেশী ভালবাসতাম বলে হয়ত সেই মুহূর্তে আমার মনে হতো আমার যতটুকু কষ্ট পাবার কথা না তার চেয়েও বেশী কষ্ট সে আমাকে দিতো।
আমার মেয়ে আমাকে প্রায়ই বলত, “মা, মাঝে মাঝে এই ভেবে আমার ভীষন ভয় হয় যে, বাবা হয়তো তোমার মত আমাকেও মারধর করবে।”
আমি তাকে অন্ধভাবে এতটাই ভালবাসতাম যে, তার আসল রূপ আমার পরিবার ও আমার বন্ধু বান্ধবদের কাছে অনেক বছর গোপন রেখেছিলাম। আমার বৈবাহিক জীবনে, আমি আমার পরিচয়, আমার আত্ম সম্মান, আমার পবিত্রতাকে বিসর্জন দিয়েছিলাম। পরিনামে নিরাশা আর ঘৃনা ছাড়া আর কি পেলাম। মানসিক ও দৈহিক সব দিক থেকেই সে আমাকে অগ্রাহ্য করতো। মনে হতো আমি তার কাছে ঘরের আসবাবপত্রের মত, যখন ইচ্ছা তখন ব্যবহার করবে।
সে বুঝতো না যে, সে যতবার আমাকে শারীরিকভাবে মারধর করছে ততবার তার প্রতি আমার সম্মান ও ভালবাসা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। শারীরিক নির্যাতন না করে, সে যদি সৎ ও মানবিক কাজটি করত এবং অমিলের কারণে আমাকে তালাক দিতো তাহলেই ভাল হতো। কিন্তু সে তা না করে তার নিজের আত্ম-সম্মানকে বড় করে দেখতো। আমি যাকে ভালবাসতাম তাকে ছেড়ে যেতে চাইতাম না, আর যাকে ভালবাসতাম সেই মানুষটিরই কোন অস্তীত্ব ছিল না—এই উভয় সংশয়ের মাঝে পড়ে আমার মন যন্ত্রনায় চিঁড়ে দু‘ভাগ হয়ে গিয়েছিল আর এই কারণেই আমি তার সাথে থাকতাম।
আশ্চর্য বিষয় হল, আমার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, সে অন্য একজন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু সে পুরো এক বছর ধরে বিষয়টিকে অস্বীকার করেছে। তবুও সে যখন চাইতো আমাকে ব্যবহার করতো, আমাকে নির্যাতন করতো। আমি একেবারে ভেঙ্গে পড়লাম, পাগলের মতো হয়ে গেলাম। ঘুমাতে পারতাম না, খেতে পারতাম না। শুধু ওর সাথেই না আমি অন্যদের সাথেও খুব কম কথা বলতাম। এতে ধীরে ধীরে আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিলাম।
এই সবকিছু আমার মেয়ের সামনেই ঘটেছিল। সে এখনও বলে যে, “বাবা মাকে ধাক্কা দিয়ে বাথরুমে আটকে রেখেছিল।” আমার মেয়ে আমাকে প্রায়ই বলত, “মা, মাঝে মাঝে এই ভেবে আমার ভীষন ভয় হয় যে, বাবা হয়তো তোমার মত আমাকেও মারধর করবে,”।
আমার ছোট্ট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সবকিছু সহ্য করতাম। কারণ আমি চাইনি যে আমার মেয়ে তার বাবা-মাকে আলাদাভাবে থাকতে দেখুক। কিন্তু আমাদের পরিস্থিতি দিনে দিনে এতটাই মারাত্বক হয়ে উঠছিল যে আমার মেয়ের পক্ষে স্বাভাবিকভাকে বেড়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
বছরের পর বছর ধরে সে আমাকে সবদিক থেকে শারীরিক নির্যাতন করতো। নির্যাতনের কোন কোন সময় সে বলতো আমাকে তার আর প্রয়োজন নেই, আমার মরাই ভাল। সে যখন এই কথা বলতো মনে হতো সবকিছু যেন শেষ। এমনও হয়েছে যে ওর সামনেই আমি নিজেকে শেষ করে দিতে যেতাম। পিঠের ব্যথার কারণে যে মরফিনযুক্ত ব্যথার বড়ি খেতাম, সেগুলো একদিন মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে ফেললাম।
আর এই ঘটনার পর পরই আমার জীবন পাল্টে গেলো। খুবই ভয়াবহ ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল সময়টা, যখন আমাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় আইসিইউ-তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর আমি শ্বাস নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। খুবই হতাশ ও বিষন্ন লাগছিল। শুধুই মরে যেতে চাইছিলাম। আমার বাবা মা পাশে থেকে আমাকে উৎসাহ ও শক্তি দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার ভাল হয়ে উঠবার জন্য এগুলো আমার ভীষণ প্রয়োজন ছিল। আমি এক বছর যাবৎ আংশিক বিষন্নতার সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম, তাই আমাকে বিষন্নতা কাটিয়ে উঠবার ঔষধ খেতে হচ্ছিল। আমি হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম এবং ভগ্নচূর্ণ ও পাশবিক সম্পর্কের জন্য, আমার এই মূল্যবান জীবনকে শেষ করে দেবার চেষ্টা করার জন্য, ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাচ্ছিলাম। আমি হৃদয় খুলে চিৎকার করে কাঁদছিলাম। আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসার পর মনে হলো যেন আমি আর আগের মত দূর্বল নই।
আমার ভিতরে একধরণের শক্তি অনুভব করলাম। আমার এই কষ্টভোগের কারণে আমি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠলাম যে, - কোনকিছুই আমাকে আর আঘাত করতে পারবে না। বিয়ের কয়েক বছর পর থেকে আমি যে ব্যর্থ সম্পর্কের মধ্যে বন্দি ছিলাম তা থেকে মুক্ত হতে চাইছিলাম। আমি একজন আত্ম-নির্ভরশীল নারী হতে চাইছিলাম, যার কোন পুরুষের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল না। অবশেষে আমি সেই পাশবিক সম্পর্কের বেড়াজাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসতে শুরু করলাম। আমারও দোষ ক্রুটি ছিল। তবু আমি আমার উপর পাশবিক নির্যাতন চালাবার আর সুযোগ দিতে চাইলাম না। যে মানুষটি আমাকে জীবনকে শূন্যের দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়েছিল, তার সাথে একই ছাদের নীচে থাকবার ইচ্ছা হারিয়ে ফেললাম।
এতে আমার উপর থেকে সে সব নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললো
দিনে দিনে আমি আরো মানসিকভাবে শক্ত হয়ে উঠছিলাম। প্রার্থনা আর সহযোগীতা আমার সহ্যশক্তি বৃদ্ধি করছিল, আর আমার মেয়েকে নিয়ে ফলপ্রসূ জীবনে বেঁচে থাকবার প্রেরণা যুগিয়ে দিচ্ছিল। যখনই সে ঝগড়া করতো আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারতাম। এতে আমার উপর থেকে সে সব নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললো। অবশেষে আমি যখন বুঝতে পারলাম যে, আমি তো নির্যাতিত ও ব্যবহারের পাত্র হয়ে থাকার জন্য বিয়ে করিনি, বরং একা থেকে আমার মেয়েকে একটি অত্যাচারি বৈবাহিক সম্পর্কের হাত থেকে দুরে রাখা আমার উচিত, তা ভাবতেই আমার সমস্ত দুঃখ কষ্ট খড়কুটার মত নিমিষে ভেসে গেলো। মনে হলো নরক যন্ত্রনা থেকে বেঁচে গেলাম। এক নতুন জীবনের সূচনা হলো।
আমি জানতাম আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, আর সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মন খুলে চিৎকার করে কাঁদতাম। কান্না শেষ হলে পর একই বিষয় নিয়ে আর কাঁদবো না বলে মনস্থির করতাম। আজ আমি মন খুলে হাসতে পারি কারণ আমি বেঁচে আছি। আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম, কিন্তু দৃঢ় মনোবল ও সংকল্প নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি।
কোন মেয়েরই শারীরিক নির্যাতন সহ্য করা উচিত নয়। আপনি যদি এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, তবে মনে রাখবেন, আপনি দূর্বল নন, আবার একাও নন। সামনে এগিয়ে যাবার জন্য আপনার যথেষ্ট মনোবল আছে। উপযুক্ত কারো সাহায্য নিন, সহযোগিতা নিন। আপনার এই যাত্রায় আমাদের একজন অনলাইন মেন্টর (পরামর্শদাতা) আপনার পাশে থেকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। অনুগ্রহ করে আপনার যোগাযোগের তথ্য নীচে লিখে পাঠাবেন। অতি শীঘ্রই আপনার সাথে আমরা যোগাযোগ করবো।
#####লেখকের নাম গোপনার্থে বদল করা হয়েছে
আপনার একা লড়াই করার প্রয়োজন নেই। একজন নির্দেশকের সাথে কথা বলুন, এটি গোপন থাকবে।
এই সংগ্রামের সাথে লড়াই করা কঠিন। আপনি যদি নিজের বা অন্যকে ক্ষতি করার কথা ভেবে থাকেন তাহলে, এটি পড়ুন!
দয়া করে নীচের ফর্মটি পূরণ করুন যাতে আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। উল্লেখিত ফিল্ট ছাড়া বাকি সব ফিল্ডগুলি আবশ্যক।