শত্রুর সাথে বসবাস
যখন আমরা ডেটিং করতাম, ও আমাকে দামী দামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেত, আর দামী দামী ডিনার আর উপহার দিয়ে আমাকে খুব খুশি রাখার চেষ্টা করত। এখন যখন আমি অতীতের দিকে তাকাই, আমি বুঝতে পারি যে তার কথার আড়ালে আমি কিছু হিংস্র স্বভাব দেখতে পেয়েছিলাম, কিন্তু আমি বুঝতে পরিনি যে ওগুলো আমার জন্য একদিন এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে। আমি দেখতাম অনেক সময় কথার ছলে সে তার নিজের দোষ অন্যের উপর চাপিয়ে দিত। যখনই সে কারোর উপর রাগ করত তখনই সে নীরবে ভাবত কীভাবে তার উপর প্রতিশোধ নেয়া যাবে। তার আচরণে আমি অনেক সময় বদরাগি স্বভাব দেখতে পেয়েছিলাম।
দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে, আমি নিজেও এমন এক পরিবারে বেড়ে উঠেছিলাম যেখানে নির্যাতন আর সহিংসতা ছিল নিত্য দিনের বিষয়। এই কারণে তার ওই আচরণ আর ব্যবহার আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল।
বিয়ের প্রথম পাঁচটা বছর বেশ ভালই কেটেছিল। সে আমার প্রতি ভীষণ যত্নশীল ও মনোযোগী ছিল। আমাদের খুব তাড়াতাড়ি সন্তান হল। কিন্তু কেন জানি না এর পরের পাঁচটা বছর আমি মানসিকভাবে খুবই অস্থির আর অশান্ত থাকতাম। ধীরে ধীরে, সে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল, কিন্তু পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্য তাকে কিছু বলতাম না। তার পরের বছরগুলোতে আমি দেখেছি যে প্রায় সময়ই যখন সে রেগে যেত, সে গোপনে প্রতিশোধ নিত বা নেয়ার পরিকল্পনা করত।
পরের চারটা বছর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার প্রতিশোধ নেয়ার প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। কোনো কোনো সময় দেখা গিয়েছে যে সে আমার সাথে এমন আচরণ করত যেন আমি ওই বাড়িতে থাকিই না, আমার কোন অস্তিত্বই নেই। আমার সাথে রাগ করলে সে আমার আমার ‘হাত-খরচ‘ দেয়া বন্ধ করে দিত।
সে আমাকে যে নামে ডাকলে আমি খুশি হতাম, সেই নামে না ডেকে অন্য নামে ডেকে আমাকে ভীষণ কষ্ট দিত। যখন সে বাসায় থাকত, তখনই আমার কাছ থেকে এটা সেটা চেয়ে আমাকে সবসময় ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার সাথে ঝগড়া-ঝাটি করত। মানসিকভাবে সে আমাকে এত অপমান করত আর ছোট করত যে আমার মানসিক অবস্থা বা সুস্থতা নিয়ে আমার নিজেরই সন্দেহ হতে শুরু হল। কিছু কিছু সময় আমি তাকে কিছু ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিতাম কিন্তু সাথে সাথে সে দিব্যি বা কসম খেয়ে বলত যে ওই রকম কোন কিছু সে করেইনি বা ওরকম কিছু ঘটেইনি। এমনভাবে ঘটনাগুলো সাজিয়ে বলত, আমিই বিশ্বাস করতে শুরু করতাম যে হয়তো আমিই ভুলে গিয়েছি আসলে কী ঘটেছিল। আমি খুবই খারাপ একজন স্ত্রী, খারাপ একজন মা, আর এই কারণে সে আমাকে ঘৃণা করে। সে প্রায়ই বলত যে তার বন্ধুরা দুঃখ করে যে কেন সে আমার মত একজন ডাইনীকে বিয়ে করেছে। এইসব কথা বলে সে আমাকে মানসিকভাবে অনেক আঘাত করত।
আমার অনেক কষ্ট হত কিন্তু তারপরেও আমি কখনই তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি কারণ আমার পরিবারেও ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছিল আর আমি জানি যে এই ঘটনা পরিবারের সন্তানদেরকে কতটা কষ্ট দিতে পারে। আমি বিয়ের সময় নেয়া প্রত্যেকটি শপথ আর প্রতিজ্ঞাকে ভীষণ আন্তরিকতার সাথে গুরুত্ব দিয়েছিলাম এবং সেগুলোকে রক্ষাও করেছিলাম।
আমার বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন ছিল, যেদিন সে আমাকে বলল, যে সে আমার মরা মুখ দেখতে চায়। কথাটা বলে সে যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল তখন আমি হতবাক আর স্তম্ভিত হয়ে টেবিলে বসে পড়লাম। আমার মুখ থেকে কোন কথাই বের হচ্ছিল না। চিন্তায় পড়ে গেলাম যে ও কি আমার গাড়ীতে কোন ঝামেলা করে রেখেছে কি না, নাকি আমার সাথে মজা করছে? আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। কী করব কীভাবে করব কিছুই মাথায় আসছিল না। পরের দিন, আমি দুপুরে রান্নাঘরে বসে খাচ্ছিলাম, সে এসে বলল, "আমি তোমার মরা মুখ দেখতে চাই, কথাটা শুনতে তোমার কেমন লেগেছিল?“ আমি বললাম,“আমার ভীষন কষ্ট হয়েছিল" সে শুধু মুচকি হাসল আর চলে গেল।
এর কিছুদিন পরই, সে আমার গায়ে হাত তুলল। সেই দিনই ছিল আমার ধৈর্য আর সহ্যের শেষ। আমি আমার সব জিনিস ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে হোটেলে চলে যাই। আমি আমার চার্চের ফাদারের কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলাম। তিনি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল মানুষ ছিলেন এবং তিনি বললেন আমার স্বামীর সাথে কথা বলবেন। কিছুদিন পর আমি আবার আমার বাড়ি ফিরে আসি।
কিন্তু যখনই সে জানতে পারল যে, আমার চার্চের ফাদার সবকিছু শুনেছে, সেই দিনের পর সে আর কখনও আমার গায়ে হাত তুলেনি। কিন্তু যখন আমাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হত, সে আমাকে ফ্লোরে ফেলে এমন শক্তভাবে ধরে রাখত যেন আমি ঘর থেকে বের হতে না পারি। সে আমাকে অনেক সময় খালি পায়ে, ঘরের কাপড় পরা অবস্থায় দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখত। ঘুমিয়ে থাকলে অনেক সময়, হঠাৎ করে গায়ের চাদর সরিয়ে দিত। এরকম করার পর যখনই আমি তাকে বলতাম যে আমি ভয় পেয়েছি আর আমার বুক ধড়ফড় করছে। সে বলত, “ভালই তো, হার্ট-এ্যাটাক করে মরে যাও”।
পরে আমি জানতে পারি যে, এই নিষ্ঠূর আচরণগুলো আসলে এক রকম শারীরিক নির্যাতন। সে প্রায় সময় আমাকে জোর করত আর বলত যেন আমি আমার সন্তানদের বলি যে তাদের বাবা আমার সাথে কোন খারাপ আচরণ করছে না বা করেনি। কিন্তু আমি আমার বাচ্চাদের সাথে মিথ্যা কথা বলতে পারিনি। কারণ আমি এই কষ্ট ভোগ করেছি, আমি ভুক্তভোগী। আমি জানতাম যে আমি যদি আমার সন্তানদেরকে মিথ্যা বলি তাহলে তারা এই অত্যাচারকে স্বাভাবিক আচরণ মনে করতে শুরু করবে।
মানসিক নির্যাতন কী, এর অর্থ কী, এগুলোর উত্তর আমি খুঁজতে শুরু করলাম, যেন আমি আমার স্বামীকে বুঝাতে পারি যে সে আমার সাথে যেসব আচরণ করছে সেগুলো আসলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। কিন্তু, আমি সে রকম জোরালো বা সংক্ষিপ্ত কোন সংজ্ঞা খুঁজে পাইনি। খুব হতাশার কারনে আমি National Domestic Violence হট লাইনে ফোন করি আর একজন উকিলের সাথে কথা বললি। উনিই আমাকে নিশ্চিত করে বললেন যে, আমার সাথে যা যা ঘটছে বা ঘটেছে সেগুলো সত্যিই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। উনি আমাকে Local Women’s Crisis Center এ গিয়ে সেখানকার একজন পরামর্শদাতার সাথে কথা বলতে বললেন, আর আমি তাই করলাম। পরামর্শদাতাকে আমি সব খুলে বললাম যে কেন আমি আমার স্বামীকে ছেড়ে যেতে চাইনি। পরামর্শদাতা আমাকে বুঝিয়ে বললেন যে আমার স্বামী, অনেক আগেই আমাদের বিয়ের শপথগুলো লঙ্ঘন করে ফেলেছে। উনি আমাকে এটাও বোঝালেন যে, যদি আমি তার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাই, তবে যেসব ঘটনা এখন পর্যন্ত গোপনে ঘটছিল, এখন সেগুলো বাইরের মানুষ জানবে কিন্তু তাতে কোন সমস্যারই সমাধান হবে না, কোন লাভ হবে না।
উনি আমাকে একজন গৃহ নির্যাতন বিষয়ক উকিলের ফোন নম্বর দেন। আমি ওনাকে ফোন করলাম, আর বললাম যে, আমি একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছি, কারণ আমার স্বামী বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হচ্ছে না। উত্তরে উকিল বললেন, "কেন? আপনি কেন যাবেন, আপনার স্বামী বাড়ি ছেড়ে যাবে।" আমি যখন তাকে বললাম যে সে যেতে রাজি হচ্ছে না, তখন উনি বললেন, যে আমি কোর্ট থেকে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সুরক্ষার আদেশ পত্রটা হাতে পাওয়ার সাথে সাথে, সে চলে যেতে বাধ্য।
ছয় সপ্তাহ পর আমি আবারও National Domestic Violence হট লাইনে ফোন করি, আর তারপর আমি তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তুত হই। আমি গাড়ি চালিয়ে আদালতে যাই, আর আমার উকিলের সাথে দেখা করি এবং সে আমার ও আমার সন্তানদের সাথে যেসব খারাপ আচরণ করেছে সেগুলো সব ওনাকে খুলে বলি। উনি আমাকে একটি অস্থায়ী প্রতিরোধ ও সুরক্ষার আদেশ পত্র দেবার অনুমতি দেন। বিচারক ওই আদেশ পত্রে আমার বাচ্চাদের নামও যুক্ত করেন। সেদিন, আমি বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসি আর পুলিশকে ফোন করে আসতে বলি। আমার স্বামীকে তো আমি অনেক বছর ধরে চিনি, জানি, তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম যে সে যে কোন ধরনের গণ্ডগোল বাধাতে পারে। তাই আমি আমার বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে পুলিশকে খবর দিই। আমার বাড়ির দরজা, গ্যারেজ আর অ্যালার্ম সিস্টেমের লক কোড বদলে ফেলি।
আমরা খুবই দুঃখজনক একটি বিবাহবিচ্ছেদের লড়াই করেছি। যেহেতু ২০ বছর ধরে আমি আমার সন্তানদের কাছে এটাই প্রকাশ করেছি যে আমার সাথে যা যা ঘটেছে সেগুলো স্বাভাবিক, তাই তাই ওরা বুঝতে পারছিল না আমি কেন তাদের বাবাকে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম। ওরা এখনও সেটা বোঝে না।
এগারটা বছর কেটে গেল। ওই দিনের পর আমি পারিবারিক সহিংসতা বিষয়ক সাপোর্ট দলে যোগ দিয়ে বহু ব্যক্তিগত পরামর্শ পেয়েছি। আমি গৃহ নির্যাতন বিষয়ের উপর একজন উপদেষ্টা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণও নিয়েছি এবং বর্তমানে যারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তাদের সাহায্য করছি।
আমি সেই করুণ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার একটি দীর্ঘ ও কঠিন রাস্তা পার করেছি। পরবর্তীতে আমার সাথে একজন সুন্দর মনে মানুষের পরিচয় হয় যে আমাকে সম্মান করত, আগলে রাখত আর যে কখনই আমার সাথে কোন খারাপ আচরণ করত না। আমাদের বিয়ে হয়, সন্তান হয়। কিন্তু দুই পরিবারের সন্তানদেরকে লালন পালন করতে আমরা নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হই, এখনও হচ্ছি। জীবন সহজ হয়ে উঠে না কিন্তু আমার প্রথম স্বামীর সাথে যেসব কষ্টকর অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, সেটার তুলনা করলে জীবন এখন অনেক বেশি সুন্দর।
আপনি যদি গৃহ নির্যাতনের শিকার হন, তবে একা একা এই কষ্ট সহ্য না করে আমাদের অনলাইন পরামর্শদাতার সাথে যোগাযোগ করুন। তিনি এই যাত্রায় আপনার পাশে থাকবেন। দয়া করে আপনার যোগাযোগের তথ্য নীচের ফর্মে লিখুন, এবং আমরা শীঘ্রই আপনার সাথে যোগাযোগ করব।
আপনার একা লড়াই করার প্রয়োজন নেই। একজন নির্দেশকের সাথে কথা বলুন, এটি গোপন থাকবে।
এই সংগ্রামের সাথে লড়াই করা কঠিন। আপনি যদি নিজের বা অন্যকে ক্ষতি করার কথা ভেবে থাকেন তাহলে, এটি পড়ুন!
দয়া করে নীচের ফর্মটি পূরণ করুন যাতে আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। উল্লেখিত ফিল্ট ছাড়া বাকি সব ফিল্ডগুলি আবশ্যক।