হারিয়ে যাওয়া আমি’কে খুঁজে পেলাম
মাত্র আট বছর বয়সেই আমি আমার সব সুন্দর সুন্দর খেলনার বিনিময়ে কাগজ কলম চেয়ে নিতাম। বলতে গেলে, তখন থেকেই আমার লেখালেখির সখ শুরু হয়। যখনই কোন বিষয়ে আমার হৃদয় ছুঁয়ে যেত ছোট গল্প লিখতাম, কবিতা লিখতাম। পরবর্তিতে নাটকও লিখেছি। আর এই অভ্যাসটিই আসলে আমাকে স্কুলে এবং চার্চে সবার কাছ থেকে আলাদা করে দিত। কেউ বুঝতে চাইতো না কেন আমার খেলাধূলায়, গাড়ীঘোড়ায়, ভিডিও গেমে কোন আগ্রহ ছিল না। এই কারণে স্কুলে আমাকে সবসময় খেপাতো। এতে আমি নি:সঙ্গ হয়ে পড়ি।
যখন ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়তাম, স্যার প্রতি সপ্তায় ক্লাসে আমাদের ব্যক্তিগত জার্নাল লিখতে বলতেন। প্রথম প্রথম সবার মত আমিও সপ্তাহব্যাপি কি করেছি বা আগামী গ্রীষ্মের ছুটিতে পরিবারের সাথে কোথায় বেড়াতে যাব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লিখতাম। সময় গড়িয়ে গেলে পর, আমার লেখালেখির অভ্যাসটিকে মন খুলে দেবার দরজা হিসেবে এবং আমার শিক্ষকের মন জয় করবার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করি।
আমি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলাম। আর এই লেখালেখির অভ্যাসটি আমার মনের ভিতরে পুষে রাখা যন্ত্রনার হাহাকার থেকে আমাকে কিছুটা হলেও হালকা রাখতো।
কিন্তু আমার শিক্ষকের কাছে সেই নিপীড়নের বিষয়টি কখনই খুলে বলিনি। কারণ আমার ভীষন লজ্জা লাগতো। কোন কোন সময় মনে হতো সবকিছুর মত এটাও আমারই ভুল, মনে হতো ঘটনাটি আমার কারণেই ঘটেছে। ঘটনাটি চার থেকে ছয় বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। সেই সময় মনে হয়েছিল বিষয়টি গোপন রাখাটাই ভাল!
একটু বড় হওয়ার পর ঘটনাটির জন্য ভীষন লজ্জা পেতাম, মনে হতো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। নিজের উপর সন্দেহ হতো, মনে হতো আমি কি ঘটনাটি উপভোগ করেছি?
আমি নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভাবতাম আমাকে দিয়ে জীবনে কখনই কোনকিছু হবে না। আমি কাউকেই বিশ্বাস করতাম না, নিজে থেকে কখনো কারো সাথে কথা বলতাম না। স্কুলে বন্ধুরা যখন খেপাতো খুবই কষ্ট পেতাম, মনে হতো যেন আমিই তাদের ঐ সুযোগ করে দিয়েছি এবং আমিই এর জন্য দায়ী। এইসব নিপীড়ন নির্যাতনের বিষয়গুলো স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করলেও আত্ম-সম্মানবোধের অভাব, ভরসার অভাব, সাহসের অভাব ইত্যাদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার বাস্তবতাকে আড়াল করতে পারতাম না। কোন কিছুতেই আমি সুখ পেতাম না, তাই নিজেকে নিজেই ক্ষত-বিক্ষত করতে শুরু করলাম। আর সত্যি সত্যিই মনে হতো যে এই শারীরিক যন্ত্রনা আমার প্রাপ্য, কারণ আমি নিজেই এর জন্য দায়ী। অন্যান্য ঘটনার অনুভূতির বাহ্যিক বাস্তবতা বুঝতে না পারলেও ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার যে দৈহিক যন্ত্রনা সেই অনুভূতি বুঝতাম।
হাই স্কুলে পড়ার সময়টি ছিল আমার জন্য খুবই কষ্টের। বারবার যৌন নিপীড়নের ঘটনাটি চিন্তায় আসতো, আর নিজের উপর ভীষন সন্দেহ হতো। কেন আমি এই ঘটনাটি ঘটতে বাধা দেইনি? আমি কি ঘটনাটি উপভোগ করেছি? এই নিপীড়নের জন্য যে দায়ী তার ধারণাই ছিল না যে, ঘটনাটি আমাকে কতটা মানসিকভাবে ক্ষতি করেছে। কলেজে আমাকে থিয়েটার প্রোগ্রামে ভর্তি করা হলে আমার মধ্যে অবশেষে আত্ম-মর্যাদাবোধের উপলব্ধি হয়। আর এই থিয়েটার আমাকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়, মোকাবেলা করতে শেখায়, লক্ষ্য নিয়ে বেঁচে থাকতে শেখায়। তবুও আমি যৌন নিপীড়নের ঘটনাটি কাউকেই খুলে বলতে পারিনি। আমার মনের গোপন কথা কিভাবে লুকিয়ে রাখতে হয় তা খুব ভালোভাবে আমি জানতাম। বেশীরভাগই আমি আমার মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম।
বাইশ বছর বয়স থেকে সত্যিকারের বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে শুরু করি। আমি যেমনই হই না কেন যারা আমাকে ভালোবেসে এভাবেই গ্রহন করে নিতো কেবল তাদের সাথেই বন্ধুত্ব করতাম। কিন্তু আমার অতীতের বাস্তবতা আমাকে সবসময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। আমি বুঝতে পারলাম, যদি এখান থেকে বের হয়ে আসতে হয় বা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে হয় তবে আমাকে আমার মনের গভীরের ঐ সকল গুপ্ত বিষয়গুলোকে মোকাবেলা করতে হবে। হাই স্কুলে থাকতে আমার বন্ধুদের দ্বারা সবসময় অবহেলিত হতাম, কিন্তু আমার এই বন্ধুরা আমাকে তাদের বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত করতো যা আগে কখনো হয়নি। প্রকৃত বন্ধুত্ব ও ভালবাসা গড়ে তুলতে আমার খুবই কষ্ট হতো। আমার অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বাধা দিয়ে রাখতো।
এতো লজ্জা লাগতো যে বিষয়টি কাউকেই খুলে বলার সাহস পেতাম না।
এই সময়ে যৌন নিপীড়নের দৃশ্যগুলো আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠতো এবং ওগুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। যা আমার বাল্যকালের অভিজ্ঞতার মতই কষ্টদায়ক ছিল। মাঝে মাঝে মনে হতো এই বুঝি আরো একটি অপরাধ করলাম: মনে হতো কেউ যেন আমার ঘরে এসে আমার উপর একইভাবে নির্যাতন চালিয়েছে, এই ভয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠতাম। এতো লজ্জা লাগতো যে বিষয়টি কাউকেই খুলে বলবার সাহস পেতাম না।
অবহেলিত হবার ভয় আমাকে আবারও প্রচন্ড কষ্ট দিতে থাকে। কিন্তু এইবার আমি আমার খুবই ঘনিষ্ট এক বন্ধুকে আমার বাল্যকালের ঘটনাটি খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং তাই করলাম। আর এতে মনে হলো আমি মনের কষ্ট ও যন্ত্রনার দেয়াল ভেঙ্গে চুরে বাইরে আসলাম। একটি ঘনিষ্ট বন্ধুত্বই এই যন্ত্রনার মুক্তি; যে বন্ধুত্ব আপনাকে সম্মান দেবে, আপনাকে মর্যাদা দেবে, আপনার দু:খ কষ্টের কথা মন দিয়ে শুনবে। আমিও ভালবাসা মেনে নিতে শিখলাম এবং বিশ্বাস করলাম যে আমি ভালবাসা পাবার যোগ্য।
আমরা পুরুষরা প্রায়ই আমাদের কষ্টের বিষয়গুলোর গভীরে যেতে চাই না এবং সেই বিষয় নিয়ে কথা বলাকে গুরুত্বও দেই না। কারণ আমরা মনে করি এতে পুরুষ হিসেবে আমাদের দূর্বলতা প্রকাশ পাবে। এই কষ্ট থেকে বের হয়ে আসার জন্য যে জিনিসটি আমার আসলে প্রয়োজন ছিল তা হলো জোর করে মুখ খুলে আস্থাভাজন কাউকে বিষয়টি বলার পদক্ষেপ নেওয়া। অপদস্ত হবার ভয় বা অভিযুক্ত হবার ভয় পিছনে রেখে নিজের কষ্টকে মোকাবেলা করার এই অভিজ্ঞতা আমার উপর অন্যের আস্থাভাজন হয়ে উঠায় সাহায্য করেছিল। এই বিষয়ে মন খুলে কথা বলা, অন্যের সত্যিকার ভালবাসা ও সহযোগীতা মেনে নেওয়া, যা ঘটেছে তার জন্য আমি দায়ী না: এগুলোই হলো কষ্ট থেকে মুক্তির পথে পথ চলার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
আপনিও যদি তেমনি কোন যৌন নিপীড়নের কোন অভিজ্ঞতার কষ্টের সাথে মল্লযুদ্ধ করছেন বলে মনে হয়, তবে আপনার মনের ক্ষত অনেক গভীর এবং ভীষন যন্ত্রনাদায়ক। আপনি জটিল মানসিক সমস্যা নিয়ে পথ চলছেন। আপনার এই পথ চলায় আমরা আপনার পাশে আছি। এখন আর আপনি একা নন। নীচে আপনার যোগাযোগের তথ্য লিখে পাঠান। আমাদের দলের একজন পরামর্শক আপনার সাথে শীঘ্রই যোগাযোগ করবে।
আপনার সমস্ত তথ্য গোপন রাখা হবে।
আপনার একা লড়াই করার প্রয়োজন নেই। একজন নির্দেশকের সাথে কথা বলুন, এটি গোপন থাকবে।
এই সংগ্রামের সাথে লড়াই করা কঠিন। আপনি যদি নিজের বা অন্যকে ক্ষতি করার কথা ভেবে থাকেন তাহলে, এটি পড়ুন!
দয়া করে নীচের ফর্মটি পূরণ করুন যাতে আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। উল্লেখিত ফিল্ট ছাড়া বাকি সব ফিল্ডগুলি আবশ্যক।